মানবতার জয়গান গেয়েছেন যাঁরা
জাহিদ বিন মনির
মানুষ তার অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে জন্মলগ্ন থেকেই। হযরত আদম আঃ থেকে শুরু করে আজ অবধি সকল মানুষই নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে আসছে। এ লড়াই কখনোবা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কখনোবা পরিস্থিতির আবার কখনো কখনো নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই।
প্রত্যেকটি মানুষই তার জীবনকালে একটি কাজই নিষ্ঠার সাথে করে থাকে, আর তা হলো নিজের অবস্থান নিশ্চিত করা বা আপন মূল্যায়ন অর্জন করা ।
আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথটির দৈর্ঘ্য যেমন কম নয়! তেমনি মানব অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রায় যে মানুষগণ নিজেদের উৎসর্গ করেছেন তাদের সংখ্যাও অগণিত। তাই আজ মানবাধিকার দিবসে তাদের কথা স্মরণ না করেলে কি হয়!
হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি কিনা তার সমগ্র জীবন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর বিদায়ী ভাষণই যার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ-
“হে মানব মন্ডলী! তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ কর। আমি জানিনা, আগামী বছর এ সময়ে, এ- স্থানে, এ-নগরীতে সম্ভবত তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ আর হবে কি না। “হে মানব সকল! সাবধান! সকল প্রকার জাহেলিয়াতকে আমার দুপায়ের নিচে পিষ্ঠ করে যাচ্ছি। নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। প্রথমে আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রে দুধ পান করেছে, হুযাইল তাকে হত্যা করেছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ’সুদ’ কে চির দিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।
হে লোক সকল! বল আজ কোন দিন? সকলে বলল “আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজ্বের বড় দিন” সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত তার মাল সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আজকের দিনের মত, এই হারাম মাসের মত, এ সম্মানিত নগরীর মত পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে। হে মানব সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হযরত আদম (আঃ)। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। ‘তাকওয়াই’ শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।
হে লোক সকল! পুরুষদেরকে নারী জাতীর উপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় কর। নারীদের উপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে তেমনি পুরুষদের উপর রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে নারীরা স্বামীর গৃহে ও তার সতীত্বের মধ্যে অন্য কাউকেও শরিক করবেনা, যদি কোন নারী এ ব্যপারে সীমা লংঘন করে, তবে স্বামীদেরকে এ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে যে, তারা স্ত্রীদের থেকে বিছানা আলাদা করবে ও দৈহিক শাস্তি দেবে, তবে তাদের চেহারায় আঘাত করবে না। আর নারীগণ স্বামী থেকে উত্তম ভরণ পোষণের অধিকার লাভ করবে, তোমরা তাদেরকে উপদেশ দেবে ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে…”
সম্পূর্ণ ভাষণে তিনি তাঁর জীবনের যে সারাংশ বলে গেছেন শুধুমাত্র এতোটুকুই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। বাঙালি আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ। তিনি স্বরাজ্য পার্টি এর প্রতিষ্ঠাতা। সেই সময়ের সবচেয়ে ধনবান উকিল হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর ধন অকাতরে সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে বিলিয়ে দিয়ে বাংলার ইতিহাসে দানবীর হিসাবে সুপরিচিত হয়ে আছেন। উদার মতবাদ ও দেশের প্রতি দরদের কারণে তিনি হিন্দু মুসলমান সকলের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেন এবং তার এই উদার মতবাদের জন্য জনগণ তাকে দেশবন্ধু খেতাবে ভুষিত করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকার্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্বন্ধে বলেনঃ ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’
শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ।বাঙালি রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শের-এ-বাংলা (বাংলার বাঘ) এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র যখন করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয় তখন ফজলুল হক নিজ প্রচেষ্টায় তা বন্ধ করেন। জামালপুর মহকুমাতে চাকরি করার সময় তিনি জমিদার ও মহাজনের যে নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন। ১৯০৮ সালে এস.ডি.ও এর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারের সাথে মতের মিল না হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চাকুরি ছেড়ে দিলেন। বাকি জীবনে তিনি পত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতি করেছিলেন শুধুমাত্র মানবাতিকার প্রতিষ্ঠায়।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ‘মজলুম জননেতা’ হিসাবে সর্বিাধিক পরিচিত। তিনি এমনই একজন দূরদর্শী নেতা যিনি কিনা পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো।
১৯২৬ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান।১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা”। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। তিনি তার জীবনে যত আন্দোলন করেছেন সবই সাধারণ মানুষের জন্য। আর সারা জীবনই সংঘর্ষে নিমজ্জিত ছিলেন মানুষের অধিকার আদয়ের লড়াই-এ।
কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রাহী কবি। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম এবং জনপ্রিয় এই মহান কবি তার জীবনের সকল মূহুর্তই দান করেছিলেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়। তিনিই একমাত্র বাঙালি যিনি কিনা মন-প্রাণ, সামর্থ-শক্তি সবই উৎসর্গ করেছিলেন। নিজেতো সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেনই, সেই সাথে অন্যকেও উৎসাহিত করেছিলেন তার লোমহর্ষক জাগরনি লেখার মাধ্যমে। যে গানে শক্তির সঞ্চালন হয়-
‘মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’
প্রতিক্ষণ/এডি/জেবিএম